চেনা কাহিনী

চেনা কাহিনী
মুনমুন মুখার্জ্জী

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আমাদের চিরসাথী। যদিও দুঃখ থাকে আমাদের সাথে সব চেয়ে বেশী। কিন্তু একঝলক খুশির বাতাস সব ধুয়ে মুছে একাকার করে দেয়। তখন সব ভুলে আমাদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। যার রেশ কখনো কখনো সারা জীবন থেকে যায়। 
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। 

সেবার গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার ঠিক দিন ১৫/১৬ আগে একদিন রাত দুটোয় গ্রাম থেকে একটা গাড়ী এসে মা বাবাকে তুলে নিয়ে যায়।  যাবার আগে আমাকে বাবা ঘুম থেকে ডেকে তোলে বাইরের দরজা লাগানোর জন্য। তাই কিছুই শুনতে পাই নি। কিন্তু আন্দাজ করতে পেরেছিলাম নিশ্চয়ই দাদুর কিছু হয়েছে। মনটা ভার হয়ে যায়। যাবার ইচ্ছা থাকলেও কিছু করার ছিল না। বোনের মাধ্যমিক শেষ, ভাই-এর উচ্চমাধ্যমিক শেষ। কিন্তু পরদিন তার জয়েন্টের পরীক্ষা ছিল।  আর আমার কথা তো আগেই বলেছি। এমনিতেই লেখাপড়ায় আমি খুব ভালো ছিলাম না। বিশ্বাস ছিল গেলে নির্ঘাত ফেল!
দুদিন পরে এক দিদি এসে খবর দিল বাবা বলেছে আমরা সবাই যেন সকালেই গ্রামের বাড়িতে যাই বাবার মাইনের খাম নিয়ে। অশৌচ পালতে হবে। আমি একটু অবাক হই। কারণ বাবা লেখাপড়া ব্যপারে খুব শক্ত। অবশ্য আমি থাকলে গ্রামের বাড়িতে সকলের সুবিধা হবে। সবাই ব্যস্ত থাকবে। ছোট ছোট ভাই বোনদের আমার কাছে রেখে দিলে তাদের কোনো চিন্তা থাকে না। 
গ্রামের বাড়িতে যেতেই বাবা বকা দিলেন। বাবা বললেন "ফেল করলে কেউ বলবে না যে দাদু মারা গেছে তাই অশৌচ পালতে এসেছিলি, ওদের নিয়ে একটা ঘরে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে খিল লাগিয়ে পড়ার চেষ্টা কর"। বুঝতে পারলাম ওই দিদি নিজের থেকে বলেছিল। বাবা আমার এক পিসতুতো দাদাকে খবর দেন, যাতে কিছু নোট জোগার করে দিতে পারে। ঐ দাদা সাইন্সের ছাত্র, কিন্তু তিনি আর্সও খুব ভালো পড়ান।
দাদা রাত জেগে রোজ নোট তৈরী করে সকালে এসে আমাকে দিয়ে যেতেন। নোট না বলে সব জরুরী প্রশ্নের সারমর্ম বললেও ভুল হবে না। খুব ছোট করে অথচ পয়েন্ট আর কোটেশন দিয়ে। যাতে ঘরে এসে খাতা বই নিয়ে বসলেই সহজেই পড়া হয়ে যায়। 

বাবাকে বলে যান "পড়লেই distinction  পাবেই"। আমি বাবাকে বলি "ও পাগলের প্রলাপ.."। বাবা কিন্তু সাহস দিয়ে বলেন "হতেই পারে নোট যখন লিখে এনেছে তখন খাটাখাটি করে লিখেছে। ওটুকু যদি লিখতে পারিস কেউ কাটতে পারবে না।"
যাই হোক পরীক্ষার প্রস্তুতি যতটা পেরেছি নিয়ে পরীক্ষা দিলেও মনে শান্তি ছিল না। সবসময় একটা ভয়ে ছিলাম। যেদিন রেজাল্টের লিস্ট বেরোনোর কথা সেদিন বাবা সাইকেল করে কলেজ গেছিলেন লিস্ট দেখতে। বিকেল ৫টায় লিস্ট টাঙিয়ে দেবার কথা, তাই বাবা ৪টেতেই রওনা দেন। বাড়ী থেকে কলেজ স্পীডে চালালে আধ ঘন্টা সাইকেলে... 
যাইহোক ফিরে আসার কথা ৬/৬.৩০ টায়। দেখতে দেখতে ৭টা বেজে গেল, বাবা ফিরলো না। তখন মনে চাপ বাড়তে শুরু করেছে। নির্ঘাত ফেল, তাই বাবার মন খারাপ, আসতে দেরী করছে। ৯টা বেজে গেল তাও যখন ফিরল না, রেজাল্টের কথা ভুলে তখন বাবার কিছু হয়নি তো -- সেটাই মূখ্য চিন্তা হয়ে দাঁড়ায়। তখন ফোনের কোনো নাম গন্ধ ছিল না, আমরা চারজনে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছিলাম। 
রাত ৯.৪৫ এ বাবা ফিরলেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব ধকল গেছে। মা জল-টল দিয়ে  শুধালেন অত দেরীর কারণ কি--
বাবা থলি থেকে বের করলেন এক ডাউস মিষ্টির প্যাকেট। আমার হাতে ধরিয়ে বললেন খা। যাক তবে পাশ করেছি, এই ভেবে মিষ্টির প্যাকেট খুলব তখন বাবা গল্প ফাঁদেন। 
লিষ্ট দেখতে গিয়ে সবাই বাবাকে খুব সম্মান করে। রেজাল্ট নাকি খুব ভালো। তাই বাবা আশেপাশে আমাদের যত আত্মীয় আছে সবার বাড়ীতে মিষ্টির প্যাকেট বিলি করে তবে ঘরে আসেন। কারণ আমার ভাই বোনের লেখাপড়ায় যথেষ্ট সুনাম থাকলেও আমার বুদ্ধি কম বলে বদনাম ই ছিল। 
আমি তো অবাক? বাবার কাছে এত সুনাম কখনো পাই নি। সামান্য একটা রেজাল্টের জন্য বাবা এত খুশি? শুধালাম কত পেয়েছি সেটা তো বলো... বাবা বললেন আর ১ নম্বর হলে ৬০ শতাংশ হয়ে যেত। সবাই ভালো বলছিল বলে জানলাম কলেজ থেকে এবার মাত্র ৬ জন distinction পেয়েছে। 
বাবার কথা শুনে খুব আনন্দ হচ্ছিল। নিজেকে ভালোর লিস্টে পাওয়ার চেয়ে বাবা মার চোখে আমার জন্য গর্ববোধটাই আমার আনন্দের কারণ। কিন্তু শেষ কথাটা সব আনন্দ দুঃখে বদলে গেল। আমি চুপ করে বসে পরলাম। বাবা শুধালে বললাম ঐ ১নম্বর হলে আমারও হয়ে যেত distinction। পরে অবশ্যই রিভিউ করায় ৮নম্বর বেড়ে গেছিল। তখন আমার আনন্দের সীমা ছিল না। সেই ছোট্ট আনন্দঘন মুহূর্তগুলো আমার সারা জীবনের পুঁজি হয়ে থাকবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নাবুঝ

গাছ লাগাও বসুন্ধরা বাঁচাও

এক টুকরো ভালোবাসা